আমার স্বামীর চরিত্রের দোষ প্রথম যখন আমার চোখে পড়ে তখন আমি দু সন্তানের মা। মেয়েটি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী, আর ছেলেটি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। সে যে মেয়েটির সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে সে বিবাহিতা। তবে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়াতে তারা আলাদা থাকে। অফিসের টুর এর নাম দিয়ে সে মেয়েটিকে নিয়ে কক্সবাজার যেতো, সুন্দরবন যেতো, সিলেট যেতো। কয়েকদিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরতো।
আমি এর প্রতিবাদ করলে সে আমার চুলির মুঠি ধরে বললো,"কোনো কথা শুনতে চাই না। একদম চুপ। আমি কী করি না করি তা আমার ব্যাপার। তুই একদম নাক গলাবি না।"
আমি বললাম,"এটা শুধু তোমার ব্যাপার হতে পারে না। এর সাথে জড়িত আছি আমি এবং আমাদের ছেলেমেয়েরা।"
"তোর যদি ভালো না লাগে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবি। কিন্তু আমার ঘরে থাকলে কোনো অশান্তি করতে পারবি না। চুপচাপ থাকবি।"
ওর গোপন সম্পর্কটি আমি জানতে পেরেছি এটা বোঝার পর ও নিজেকে শুধরে না নিয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলো। আগে তো মেয়েটিকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সময় আমাকে বলতো অফিসের কাজে যাচ্ছে। এখন আর সেটা বলারও প্রয়োজনও বোধ করে না। তার বেপরোয়ার আরেকটি উদাহরণ হলো, আমি যখন ছেলে মেয়েদের নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে থাকতাম, সে তখন অন্য একটা রুমে মেয়েটির সাথে ভিডিও কলে সারারাত কথা বলতো। আমি গোটারাত বিছানায় শুয়ে ওর কথা, হাসির চাপা আওয়াজ শুনতাম। এভাবে কতোদিন সহ্য করা যায়?
একদিন মাঝরাতে ওর রুমে ঢুকে ওর হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে মেরে বললাম,"বন্ধ করো এসব নোংরামি। মেয়েটা বড়ো হচ্ছে। সে এখন একটু একটু বুঝতে পারছে তোমার অসভ্যতা।"
জবাবে সে পাগলের মতো রেগে গিয়ে বিছানা থেকে নেমে আমাকে নির্মম ভাবে মারতে শুরু করলো। থাপ্পড় ঘুষির পর সে আলনা থেকে বেল্ট নিয়ে আমাকে পেটাতে লাগলো। আর মুখে বলতে লাগলো,"তোর এত্তো বড়ো সাহস, তুই আমাকে বাধা দিস? তোকে আজ মেরেই ফেলবো।"
আমার আর্তনাদ শুনে ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে আমাকে বাঁচাতে এলে সে রুমের দরোজা বন্ধ করে দিলো। আর আমার শাশুড়ি আমাকে বাঁচানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনি তার রুম থেকে বের পর্যন্ত হলেন না। অথচ তিনি চাইলে তার ছেলেকে থামাতে পারতেন।
সে রাতের পর থেকে আমার স্বামীর অত্যাচার বেড়ে গেলো। সে প্রতি রাতে আমাকে মারতে লাগলো। এক সময় ওর মার থেকে বাঁচার জন্য ও বাড়িতে এলে আমি বাথরুমে ঢুকে দরোজা লাগিয়ে দিতাম। এবং মেয়েটির সাথে কথা শেষ করে ভোরের দিকে ও যখন ঘুমিয়ে পড়তো, আমি তখন বাথরুম থেকে বেরুতাম। এভাবে দিনের পর দিন না ঘুমানোর ফলে আমি ইনসমনিয়া রোগে আক্রান্ত হলাম। যে সমস্যাটি আমার এখানো আছে।
সংসার বাঁচানোর জন্য মরীয়া হয়ে একদিন আমার শাশুড়ির কাছে গেলাম। কারণ তার কথা ছেলে অক্ষরে অক্ষরে মানে।
চোখের পানি ফেলে ওনাকে বললাম,"আম্মা, আপনি তো সব দেখছেন সব জানেন। দয়া করে ওকে ফেরান।"
তিনি ছেলেকে দোষ না দিয়ে সব দোষ আমার ওপর চাপিয়ে দিলেন।
তিনি বললেন,"দোষ তো তোমার। তোমার ওপর ছেলে খুশি না বলেই তো সে অন্য দিকে গেছে। এখন নাকি কান্না কেঁদে লাভ নেই।"
"আপনি আমাকে বলুন ঘরের কোন কাজটা করতে অবহেলা করেছি? দোষটা কার সেটা তো আপনার চোখে না পড়ার কথা নয়। সবই তো দেখতে পাচ্ছেন।"
"তার মানে বলতে চাইছো আমার ছেলের চরিত্র খারাপ! তার মানে আমি ওকে মানুষ করে গড়ে তুলতে পারি নি? তাহলে সব দোষ আমার? নিজের দোষ আমার ওপর চাপাচ্ছো?"
"আম্মা, আমি এসব বলছি না। আমি শুধু বলছি, ওকে আপনি থামান। আমার কথা না হয় বাদ দিলেন, কিন্তু আপনার ছেলের সন্তানদের কথা অন্তত ভাবেন। আপনি চাইলে ওকে আটকাতে পারবেন। ও আপনার কথা শোনে। আপনাকে মানে।"
আমার শাশুড়ি আমার কথা পাত্তা দিলেন না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন,"তোমার এসব ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমি কী করবো না করবো তা আমার ব্যাপার। তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই না। যাও সামনে থেকে।"
হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ওনার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
অতঃপর আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা রইলো না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে চিরতরে স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসাতে আমার বাবা মা, ভাইয়েরা কেউ খুশি হয় নি। তাদের কথা হলো,"প্রত্যেক সংসারে এমন টুকিটাকি ঝামেলা হয়েই থাকে। এসব মানিয়ে নিতে হয়। এভাবে হুট করে স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসা ঠিক না।"
আমি যতোই তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমার স্বামীর ভয়াবহতার কথা, এবং আমার শাশুড়ির অসহযোগিতার কথা, তারা আমার কথা গুরুত্ব দেয় নি। তাদের কথা একটাই, এমন টুকিটাকি ঝামেলা সব সংসারে হয়েই থাকে। এসবকে এতো বড়ো করে দেখার কিছু নেই।
আমার বাবা মা, ভাইয়েরা আমার পরিস্থিতি বুঝতে না চেয়ে, কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করে, যেহেতু আমাদের তিনজনের খরচ এখন তাদের বহন করতে হবে, তারা আমাকে স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠানোর নানা রকম চেষ্টা করলো। কিন্তু আমার অনড় অবস্থানের কারণে তারা একসময় ক্ষান্ত হলো। কিন্তু তারা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো, আমি যদিও এখানে থাকতে পারবো, কিন্তু আমার এবং ছেলেমেয়েদের খরচ আমাকেই বহন করতে হবে। তারা এ ব্যাপারে তেমন কিছু করতে পারবে না।
নিরুপায় হয়ে আমাকে উপার্জনের কথা ভাবতে হলো। আমি ইন্টার পাশ। এই সামান্য পড়াশোনা দিয়ে ভালো চাকরি যে জোটানো যাবে না তা জানতাম। তবু হাল ছাড়ি নি। পরিচিত সবার সাথে যোগাযোগ করে ছোটো একটা চাকরি জুটিয়ে নিলাম। ঐ অল্প আয়ে তিনজনের সংসার চলতো না বলে চাকরির পাশাপাশি রাতে সেলাইয়ের কাজ করতাম। সারাদিন অফিস করতাম আর তারপর মাঝরাত অবধি সেলাইয়ের কাজ করতাম। এতে সংসারটা কোনো রকমে চলে যেতে লাগলো।
ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে উঠতে লাগলো। তারা মায়ের অমানুষিক খাটুনি দেখে হয়তো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতো। ফলে পরীক্ষায় তারা ভালো রেজাল্ট করতো। এতে আমার ভালো লাগতো। ভাবতাম পরিশ্রম সার্থক হচ্ছে।
আমার স্বামীর খবর নানাজনের কাছ থেকে মাঝে মাঝে পেতাম। আমি চলে আসার পর ঐ মেয়েটিকে সে বিয়ে করে। কিন্তু বিয়েটা বেশিদিন টেকে নি। কারণ বিয়ের কিছুদিন পর সে আরেকটা মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়ায়।
এর বছর খানিক পর আমার শাশুড়ির মৃত্যুর খবর পেলাম। মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে তিনি স্ট্রোক করেন। এবং বাকি জীবন অসাড় শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন।
এরপর অনেকদিন আমার স্বামীর কোনো খবর পাই নি। তারপর হঠাৎ একদিন শুনলাম, তার ক্যান্সার হয়েছে। একেবারে শেষ অবস্থা।
এ সময় সে আমাকে একদিন ফোন দিলো। নাম্বারটা কীভাবে জোগাড় করলো জানি না।
ফোনে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,"নাজমা, আর হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না। একটিবার কি তুমি আমার সাথে দেখা করতে পারো?"
আমি শান্ত স্বরে বললাম,"শুধু আমার সাথে দেখা করবে, ছেলেমেয়েদের দেখবে না? তাদের দেখতে ইচ্ছে করে না?"
"ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু ওদের বয়স কম। তারুণ্যের উদ্দীপনায় টগবগ করছে। তাদের খারাপ বাবাকে দেখে তারা ক্ষেপে উঠতে পারে। কারণ তোমার ওপর যে নির্যাতন করেছি, তাতো তারাও দেখেছে। এ জীবনে তারা কখনোই ওসব ভুলতে পারবে না। তাই.."
বাকিটা শেষ করলো না।
বললাম,"আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবো। ওদের সামলানোর দায়িত্ব আমার। আমি চাই তোমার এবং ছেলেমেয়েদের দেখা হোক।"
ছেলেমেয়েরা শুরুতে বাবার সাথে দেখা করতে চায় নি। বাবার ওপর অনেক রাগ ঘৃণা জমে আছে তাদের। কিন্তু যখন বললাম তাদের বাবার শেষ অবস্থা, তখন তারা রাজি হলো।
আমরা একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করলাম। একটা টেবিল ঘিরে আমরা চারজন বসে আছি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, একটা সুন্দর পারিবারিক মিলন দৃশ্য। বাবা মা ছেলেমেয়ে। অথচ বাহিরের কেউ জানতে পারবে না, এটা কোনো সুন্দর পারিবারিক মিলন দৃশ্য নয়। এটা দুঃখ, রাগ, ক্ষোভে ভরা একটা মিলন দৃশ্য।
রোগের কারণে সে অনেক শুকিয়ে গেছে। যতোক্ষণ আমরা ছিলাম, আমাদের মাঝে একটিও কথা হয় নি। সে হাত জোড় করে শুধু কেঁদেছে। শুধু কেঁদেছে।
আমাদের দেখা হওয়ার এক মাস পরই সে মারা যায়।
কারো মৃত্যুতে জীবন থেমে থাকে না। জীবন তার গতিতে চলতে লাগলো। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হলো। আমি নানী হলাম, দাদী হলাম। মেয়েটা তার স্বামীর চাকরির কারণে দূরে থাকে। ছেলেটা আমার সাথে থাকে।
ছেলেটার মেয়ের বয়স যখন তিন বছর হলো, তখন একদিন শুনলাম, ছেলে আর ছেলের বউ তাদের রুমে ঝগড়া করছে। কী নিয়ে ঝগড়া করছে বুঝতে পারলাম না। এরপর থেকে প্রায় দেখতাম তাদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে।
এক রাতে ছেলের বউ কাঁদতে কাঁদতে আমার রুমে এলো। এবং কাঁদতে কাঁদতে বললো,"আম্মা, আমার সংসারটাকে আপনি বাঁচান। আপনি চাইলে ওকে ফেরাতে পারবেন।"
"কী হয়েছে ওর? আমাকে খুলে বলো।"
"ও অন্য একটা মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছে। আমার কোনো কথাই সে শুনতে চাইছে না। কিছু বললে সে মারার জন্য তেড়ে আসে। আম্মা, আমাদের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। এই অবস্থায় সংসারটা ভেঙে গেলে মেয়েটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো?"
মুহূর্তে নিজের জীবনের অতীতের কথা মনে পড়ে গেলো। চোখের সামনে যেনো সব দেখতে পেলাম। আমি গাঢ় বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
সে রাতে বারোটার দিকে ছেলে বাড়ি ফিরলো। সে ইদানীং প্রায় দেরি করে বাড়ি ফেরে। বউমার কাছ থেকে শুনলাম, এই দেরির কারণ হলো, অফিস শেষে সে মেয়েটার সাথে সময় কাটায়।
অন্য দিনের মতো সে রাতেও তাদের মধ্যে ঝগড়া হতে লাগলো। এক পর্যায়ে ছেলের বউয়ের আর্তনাদ শুনলাম। ঠিক যেভাবে আমি আর্তনাদ করতাম আমার স্বামীর মার খেয়ে। নিমিষে আমার পুরো শরীরে তীব্র রাগের আগুন ছড়িয়ে পড়লো।
আমি রুম থেকে বেরিয়ে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ছেলের রুমে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, ছেলে বউয়ের চুলের মুঠি ধরে আছে।
আমি সরাসরি ছেলের সামনে গিয়ে ওর গালে প্রচণ্ড একটা চড় মারলাম। ও আচমকা চড় খেয়ে বউয়ের চুলের মুঠি ছেড়ে দিলো।
আমি তখন প্রবল ক্রোধের সাথে ছেলেকে বললাম,"যে অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি, আমার বউমাকে এবং তার ছোট্ট মেয়েটাকে সে কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে দেবো না। এসব নোংরামি আমি সহ্য করবো না। খবরদার সহ্য করবো না।"
আমার এই আকস্মিক আচরণে ছেলে প্রথমে অবাক হলেও পরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আর ছেলের বউ কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আর আমি ছেলের বউয়ের পিঠে হাত রাখলাম। পরম নির্ভরতার হাত।
সমাপ্ত
0 Comments