ফাহিম অফিসের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরুনোর মুহূর্তে অধরা তৃতীয় বারের মতো বললো,"আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। রাতে এ উপলক্ষ্যে কিছু আয়োজন করবো। কাছের অল্প কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করবো। খুব ঘরোয়া ভাবে অনুষ্ঠানটা করতে চাই। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরো। অন্য দিনের মতো দেরি কোরো না।"
যথা সময়ে বাড়ি ফিরবে কথা দিয়ে ফাহিম বেরিয়ে গেলো।
অফিস ছুটির আগে আগে ফাহিমের এক বন্ধু এসে হাজির। বন্ধুটি শহরের অভিজাত এলাকায় একটা ডিলাক্স রেস্টুরেন্ট খুলেছে। সে এসেছে ফাহিমকে সেখানে নিয়ে যেতে।
"দোস্তো তোকে আমার রেস্টুরেন্টে নেয়ার জন্যই তোর অফিসে এসেছি। না করবি না।"
ফাহিমের তখন অধরার কথা মনে পড়লো। সাতটার মধ্যে তাকে বাড়ি ফিরতে বলেছিলো। এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। বন্ধুর ওখানে গেলে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফেরার সম্ভবনা কম। সময় মতো না ফিরলে অধরা নির্ঘাত রেগে যাবে। ঐ মেয়ের রাগ সাংঘাতিক। রেগে গেলে চিৎকার চেঁচামেচি করে না, কিন্তু এমন শীতল আচরণ করে যে, বুক ফালি ফালি হয়ে যায়।
সে বন্ধুকে বললো,"আজ একটু কাজ আছে। সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে। কাল নিশ্চয়ই তোর রেস্টুরেন্টে যাবো।"
বন্ধু কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললো,"বউকে এতো পাত্তা দিস কেন? এটা কি পুরুষের মতো কথা হলো! মেয়েরা ভালোবাসার কী বোঝে! ওদের জ্ঞান বুদ্ধি কিছু আছে! ওরা মূর্খ, অকৃতজ্ঞ।"
তারপর অশ্লীল ইঙ্গিতে বললো,"ওরা হলো স্রেফ ভোগ্য পণ্য।"
কথাগুলোয় ফাহিম অসন্তুষ্ট হলো। কারণ অধরা আর সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো।
ফাহিমের অসন্তুষ্টি বুঝতে পেরে সে বললো,"আচ্ছা ঠিক আছে ভাবিস না। গাড়িতে একটানে রেস্টুরেন্টে যাবো। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আরেকটানে তোকে বাড়ি পৌঁছে দেবো। কথা দিচ্ছি সাতটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে দেবো। আর চিন্তা করিস না চল।"
কিছুটা অসম্মতিতেই সে বন্ধুর গাড়িতে উঠলো। আর নিজের গাড়ির ড্রাইভারকে বললো গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে।
ফাহিম রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখলো, সেখানে আরো বন্ধুরা এসে উপস্থিত। অনেক দিন পর বন্ধুরা একসাথে হওয়াতে হৈচৈ হলো প্রচুর। খাওয়া দাওয়া, মিউজিক, মদ্যপান, কোলাহলে ফাহিম ভুলে গেলো বিবাহবার্ষিকীর কথা। ফাহিমের এক সময় পানের অভ্যেস ছিলো। কিন্তু অধরার কারণে সেটা ছেড়ে দিয়েছিলো। আজ বহুদিন পর সব উলোটপালোট হয়ে গেলো। অধরা যে বারবার ফোন করেছিলো সে রিং টোনও তার কানে পৌঁছায় নি।
বন্ধুর গাড়িতে যখন বাড়ি ফিরলো তখন রাত বারোটা। মদ্যপানের কারণে তখনো তার মাথায় ছিলো না সে যে বিরাট ভুল করেছে। দারোয়ান গেট খুলে দিলে সে গুনগুন করে গাইতে গাইতে ঘরের দরোজার কাছাকাছি এসে দেখলো দরোজা বন্ধ। একাধিক বার কলিং বেল বাজানোর পরও কেউ দরোজা খুললো না। কিছুক্ষণ পর দরোজার পাশের জানালায় এসে দাঁড়ালো তার পাঁচ বছরের ছেলে শাওন। ছেলেকে দেখে সে কিছুটা অবাক হয়ে বললো,"কী ব্যাপার শাওন, দরোজা না খুলে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কেনো? বাইরে প্রচুর ঠাণ্ডা। মাঘ মাসের ঠাণ্ডা বলে কথা।"
ছেলে একটিও কথা না বলে শুধু বাবার দিকে চেয়ে রইলো।
ফাহিম বুঝতে পারছে কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে। কারণ ছেলের আচরণ স্বাভাবিক নয়।
"শাওন, দরোজা খোলো। শীত করছে অনেক। যদিও কোট গায়ে দেয়া তবুও শীত করছে। মাঘ মাসের ঠাণ্ডা বলে কথা।"
ছেলে এবার ধীর কণ্ঠে বললো,"মা দরোজা খুলতে নিষেধ করেছে।"
ফাহিমের নেশা কাটতে শুরু করেছে দ্রুত।
"কেনো দরোজা খুলতে নিষেধ করেছে?"
"বাবা আজ তোমার সন্ধ্যা সাতটায় আসার কথা ছিলো।"
এবার ফাহিমের সব মনে পড়লো। সে বুঝলো সে বিরাট ভুল করে ফেলেছে।
ছেলে তখন বললো,"মা আজ খুব সুন্দর করে ঘর সাজিয়েছিলো। রঙিন বেলুন সোনালি ফিতে দিয়ে। কতো কিছু যে মা নিজ হাতে রান্না করলো! ছোটো মামা, বড়ো ফুফু, খালামণিরা এসেছিলো। সবাই শুধু তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। বলছিলো তুমি নেই কেনো। মা তখন বললো কী একটা জরুরী কাজে তুমি আটকে গেছো তাই আসতে পারো নি। মা হাসিমুখে সবার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছিলো, এর সাথে ওর সাথে কথা বলছিলো, হাসছিলো। কিন্তু বাবা সবাই চলে যাওয়ার পর মা পুরো ঘরে সাজানো রঙিন বেলুন সোনালি ফিতে সব টেনে ছিঁড়ে ফেললো। তারপর বিছানায় এসে চুপচাপ কাঁদতে লাগলো। আর আমাকে ডেকে বললো, তোমার বাবা এলে দরোজা খুলবে না।"
কিছুক্ষণ থামলো শাওন। তারপর বললো,"বাবা তুমি কেনো সন্ধ্যা সাতটায় এলে না? মা'কে আমি কখনো এভাবে কাঁদতে দেখি নি।"
ফাহিমের নেশা তখন সম্পূর্ণ কেটে গেছে। সে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,"বিরাট অন্যায় হয়েছে রে। বিরাট অন্যায় হয়েছে। তোমার মা এখন কী করছে?"
"বিছানায় শুয়ে আছে।"
"তুমিও লক্ষ্মী ছেলের মতো শুয়ে পড়ো। আমি একটা কাজ সেরে আসছি।"
ফাহিম কাজের অজুহাত দিয়ে ছেলের কাছ থেকে সরে যেতে চাইছিলো। সে চাইছিলো না, অপরাধী বাবার মুখ ছেলে দেখুক।
অধরাকে কষ্ট দেয়ার জন্য সে অত্যন্ত ব্যথিত হলো। ওর মতো একটা অসাধারণ মেয়েকে সে এতোটা আঘাত না দিলেও পারতো। অধরা সচরাচর কাঁদে না। ও খুব শক্ত প্রকৃতির মেয়ে। আজ সে মেয়েটিও কাঁদলো! ভীষণ অন্যায় করেছে সে।
দীর্ঘ পথ হেঁটে সে ফুলের দোকানে এলো। অধরা ফুল ভালোবাসে। বাড়ির সামনে পেছনে, ব্যালকনী, ছাদে সে চমৎকার ফুলের বাগান করেছে। দোকানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলের তোড়াটি হাতে নিয়ে সে ভাবলো, এটা হয়তো অধরা নিতে চাইবে না। যে ভয়াবহ অন্যায় সে করেছে তাতে না নেয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া বিবাহবার্ষিকীর দিনটাও তো পেরিয়ে গেছে। তবু তোড়াটি সে কিনলো।
রাত তিনটা পর্যন্ত পথে পথে ঘুরে সে বাড়ি ফিরলো পুনরায়। দারোয়ান গেট খুলে দিলো। দারোয়ান সাধারণত ফাহিমের সাথে একান্ত দরকার না হলে কথা বলে না। বাড়ির মালিককে যেমন সমীহ করা উচিত সেও তেমন করে। তবু এই রাত তিনটায় পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখে দারোয়ান কৌতূহল দমাতে পারলো না।
সালাম দিয়ে বললো,"স্যার কোনো সমস্যা?"
ফাহিম বিষণ্ণ ভাবে হাসার চেষ্টা করলো। কিছু বললো না।
দরোজার কাছে এসে দেখলো দরোজা খোলা। বেডরুমের বাতি নেভানো। অধরা আর শাওন হয়তো ঘুমাচ্ছে। সে বেডরুমের দিকে না গিয়ে ড্রইং রুমের টি-টেবিলে ফুলের তোড়াটি রেখে সোফায় শুয়ে পড়লো। দীর্ঘ হাঁটাহাঁটি এবং মদ্যপানের কারণে তার শরীর ক্লান্ত ছিলো। শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো।
মোবাইলের এলার্মের শব্দে তার সকালে ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে দেখলো তার গায়ে গরম চাদর দেয়া। এ চাদর তো সে গায়ে দেয় নি। কে দিলো এটা? মা হয়তো রাতে এসে দিয়ে গেছেন। তারপর দেখলো সামনের সোফায় চুপ করে বসে আছে শাওন। সে বাবার দিকে চেয়ে আছে।
ফাহিম শোয়া থেকে বসে বললো,"এতো সকালে ঘুম থেকে উঠেছো! এখন তো স্কুল নেই। আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে।"
"বাবা কেমন ঘুম হয়েছে?"
"খুব ভালো ঘুম হয়েছে।"
"রাতে ঠাণ্ডার মধ্যে তুমি বাইরে ছিলে। তুমি না বলো মাঘ মাসের ঠাণ্ডা বলে কথা। কষ্ট হয়েছিলো তোমার?"
ফাহিম হেসে বললো,"ঠাণ্ডা ভালোই ছিলো। কিন্তু গায়ে তো আমার কোট ছিলো। তাই খুব একটা কষ্ট হয় নি।"
মুখে যদিও বললো কষ্ট হয় নি, কষ্ট ঠিকই হয়েছিলো। গতকাল রাতে কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে একবার মনে হয়েছিলো, ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না! সে অন্যায় করেছে এটা অস্বীকার করছে না। এর জন্য অধরা তাকে ইচ্ছে মতো বকাঝকা করতে পারতো। তা না করে এই হাড় কাঁপানো শীতের রাতে তাকে ঘরে ঢুকতে না দেয়াটা কি একটু বেশি হলো না! তারা যে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। একে অন্যকে সারাজীবন ভালোবাসার কথা দিয়েছিলো। অধরা কি তবে বদলে গেলো! যেমন বদলে গেছে সে নিজে। তার এও মনে হয়েছিলো, সে এই তীব্র শীতের রাতে কাঁপতে কাঁপতে পথে পথে হাঁটছে আর অধরা ঘরের উষ্ণতার মাঝে আরামে ঘুমাচ্ছে। পরক্ষণে অবশ্য এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেললো। সে নিজেকে বললো, সে যে অপরাধ করেছে, অধরাকে দেয়া কথা ভুলে সে মত্ত হয়েছিলে বন্ধুদের সাথে হৈচৈ মদ্যপানে, তাতে তার আরো শাস্তি হওয়া উচিত।
ফাহিম তারপর বললো,"তোমাদের ঘুম কেমন হয়েছে?"
শাওন নীরব রইলো।
"আচ্ছা কাল রাতে দরোজা কি তুমি খুলে রেখেছিলে?"
"মা খুলে দিয়েছিলো। তুমি যাওয়ার পরই মা এসে দরোজা খুলে দিয়েছিলো।"
"তারপর বুঝি তোমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলে?"
শাওন অল্প কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,"বাবা কাল সারারাত মা একটুও ঘুমায় নি।"
ফাহিম নড়েচড়ে বসলো। এরপর শাওন যা বললো তা ছিলো ফাহিমের কাছে অকল্পনীয়।
শাওন বলে যেতে লাগলো,"তুমি রাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর মা এসে দরোজা খুলে দিলো। তারপর আমাকে নিয়ে রুমে গেলো। আমাকে শুইয়ে দিয়ে মা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমার কিন্তু তখনো ঘুম আসে নি। খানিক পর পেছনের দরোজা খোলার শব্দ পেলাম। আমি তখন বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে গেলাম। দেখলাম মা বাড়ির পেছনের বাগানে খোলা আকাশের নিচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে শাড়ি ছাড়া কোনো গরম কাপড় ছিলো না। তুমি যখন ঘরে ঢুকেছিলে মা টের পেয়েছিলো। তুমি সোফায় ঘুমিয়ে পড়লে মা তোমার গা চাদরে ঢেকে দিয়েছিলো। আর ফুলের তোড়াটি দু'হাতে বুকের কাছে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। তারপর ওটা টেবিলে রেখে মা আবার পেছনের বাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। আলো ফোটার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলো। বাবা মাঘ মাসে খুব ঠাণ্ডা পড়ে, তাই না?"
ফাহিম রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বেশ কিছুক্ষণ সে কোনো কথাই বলতে পারলো না।
তারপর অস্থির স্বরে বললো,"তোমার মা এখন কোথায়?"
"রান্নাঘরে। নাস্তা বানাচ্ছে।"
ফাহিম ছুটে গেলো রান্নাঘরের দিকে। দরোজায় দাঁড়িয়ে দেখলো অধরা রুটি সেঁকছে। আর পাশে রুটি বেলছে কাজের মেয়ে।
ফাহিম কাজের মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললো,"শিল্পী তুই একটু বাইরে যা।"
কাজের মেয়ে চলে গেলে ফাহিম রান্নাঘরে ঢুকলো। অধরা যেনো কিছুই দেখে নি, কিছুই শোনে নি। সে রুটি সেঁকে যেতে লাগলো। ডিম ভাজতে লাগলো। টোস্ট করতে লাগলো। জেলি লাগাতে লাগলো।
ফাহিম আস্তে করে ডাকলো,"অধরা..।"
অধরা কোনো জবাব দিলো না। সে কাজ করে যাচ্ছে নিমগ্ন হয়ে।
ফাহিম এবার কাছে এসে অধরার ডান হাত ধরলো। অধরা ছাড়িয়ে নিলো না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো।
কতো কথা বলবে বলে ছুটে এসেছিলো ফাহিম। কিন্তু এখন দেখলো কোনো কথাই মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না।
সে কেবল বলতে পারলো,"অধরা..।"
অধরা শান্ত গলায় বললো,"এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে যাও। আমি নাস্তা দিচ্ছি। তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাবে।"
এবার ফাহিম সামান্য গলা চড়িয়ে বললো,"যাকে সারাজীবন ভালোবাসবো বলে কথা দিয়েছিলাম, সে প্রচণ্ড শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমি ঘুমিয়ে থাকবো গরম চাদরে আবৃত হয়ে নরম সোফায়! জাহান্নামে যাক অফিস। জাহান্নামে যাক ক্যারিয়ার।"
প্রত্যুত্তরে অধরা কিছুটা দোষীর মতো বললো,"আমিও তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসবো বলে কথা দিয়েছিলাম। অথচ আমার কারণে শীতের রাতে তোমাকে বাইরে থাকতে হয়েছিলো।"
ফাহিম দৃঢ়তার সাথে বললো,"তুমি কথা রেখেছো অধরা। অনেক বেশি রেখেছো। আমি রাখতে পারি নি। গতকাল যে জঘন্য অপরাধ করেছি তার জন্য আমার ভীষণ শাস্তি হওয়া উচিত।"
ঠিক তখন ফাহিমের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ফোন দিয়েছে গতকালের সেই বন্ধুটি। যার অভিজাত রেস্টুরেন্টে গিয়ে যতো সর্বনাশ হয়েছিলো। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মদ্যপানও করেছিলো। আর তারপরই সব এলোমেলো হয়ে গেলো। বন্ধুটি বলেছিলো সাতটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে দেবে। কিন্তু সে কথা রাখে নি। বরঞ্চ সেই সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত করেছিলো মদ্যপানে।
ফাহিম ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বন্ধুটি খুশিয়াল গলায় বলে উঠলো,"দোস্তো ঘুম ভাঙলো! আর আমি সবে ঘুমাতে যাচ্ছি। ভাবলাম দোস্তোর একটু খবর নিই। কাল নিশ্চয়ই জবরদস্ত ঘুম হয়েছিলো। আজকে আবার চলে আসিস। আজকের আয়োজন আরো ধামাকা। রেয়ার কিছু বিদেশি ড্রিংকস এর ব্যবস্থা করেছি। সহজে এসব পাওয়া যায় না। রাতের দিকে চলে আয়। কাল কেমন মাস্তি হলো বল। তুই তো তাড়াতাড়ি চলে গেলি। আসল মজা করতেই পারলি না। আমরা তো সারারাত থাকি। ফুল নাইট মাস্তি। আরে বউকে এতো পাত্তা দিলে হয় না। পরুষ হ। মেয়েরা ভালোবাসার কী বোঝে! ওদের জ্ঞান বুদ্ধি কিছু আছে! ওরা মূর্খ, অকৃতজ্ঞ। ওরা হলো স্রেফ ভোগ্য পণ্য।" বলেই নোংরা ভাবে শব্দ করে হাসতে লাগলো।
ফাহিম তখন চোখের সামনে দেখছে, অধরা রঙিন বেলুন সোনালি ফিতে টেনে টেনে ছিঁড়ছে, বিছানায় বসে চোখের পানি ফেলছে, বন্ধ দরোজা খুলে দিচ্ছে, তার ঘুমন্ত দেহ গরম চাদরে আচ্ছাদিত করে দিচ্ছে, ফুলের তোড়াটি দু'হাতে বুকের কাছে ধরে রেখেছে, সামান্য একটা শাড়ি পরে খোলা আকাশের নিচে শীতের রাতে কনকনে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে আছে। আর কানে অনবরত বাজছে, বউকে এতো পাত্তা দিলে হয় না...... মেয়েরা ভালোবাসার কী বোঝে...
ওদের জ্ঞান বুদ্ধি কিছু আছে.....পুরুষ হ....আমরা তো সারারাত থাকি....ফুল নাইট মাস্তি....হা হা হা....ফুল নাইট মাস্তি....হা হা হা....... ওরা হলো স্রেফ ভোগ্য পণ্য....হা হা হা....ওরা মূর্খ অকৃতজ্ঞ....ওদের জ্ঞান বুদ্ধি কিছু আছে.....মেয়েরা ভালোবাসার কী বোঝে....বউকে এতো পাত্তা দিলে হয় না....ওরা মূর্খ অকৃতজ্ঞ.... ওরা হলো স্রেফ ভোগ্য পণ্য.... হা হা হা....পুরুষ হ....।
হঠাৎ সীমাহীন রাগ ভর করলো ফাহিমের ওপর। কিন্তু নিজেকে কোনো রকমে সামলে সে বললো,"তোকে একটা অনুরোধ করি, মেয়েদের প্রতি তোর যে বাজে দৃষ্টিভঙ্গী সেটা পরিবর্তন কর। মেয়েদের সম্মান দিতে শেখ। মেয়েদের অশ্রদ্ধা করার মধ্যে পুরুষত্ব নেই। শ্রদ্ধা করার মধ্যে আছে।"
ওর কথার জবাবে বন্ধুটি হা হা করে হেসে বললো,"তুই এখনো শিশু রয়ে গেলি। পুরুষ হতে পারলি না। মেয়েদের সম্বন্ধে তোর কোনো ধারণাই নেই।"
তারপর একটা কুৎসিত কথা বললো মেয়েদের নিয়ে। বলে পুনরায় নোংরা ভাবে হাসতে শুরু করলো।
এবার আর ফাহিম রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।
সমস্ত রাগ কণ্ঠে এনে সে চিৎকার করে বললো,"গতকাল আমি তোর সাথে পুরুষের মতো আচরণ করি নি। আজ করছি, আমার গালি দেয়ার অভ্যেস নেই, যদি থাকতো তাহলে এখন তোকে অত্যন্ত বাজে একটা গালি দিতাম। তুই জীবনে আমার সামনে আসবি না। যদি আসিস, খোদার কসম তোর বুক আমি গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবো।"
তারপরই ফোন কেটে দিলো। সে তখনো রাগে ফুঁসছে। জীবনে এমন দুর্দান্ত রাগ তার আগে কখনো হয় নি। নিজেকে কোনো ভাবে স্থির রাখতে পারছে না। সে থরথর করে কাঁপছে।
অধরা ফাহিমের চোখে চোখ রাখলো। গতকাল সকালের পর এই প্রথম ফাহিমের চোখের দিকে সে তাকালো। এরপর আরো কাছে এসে ফাহিমের প্রবল কাঁপতে থাকা শরীরটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
ফাহিমের গলা ধরে এলো। ঐ ধরা গলায় কোনো শব্দ উচ্চারণ অসম্ভব। তবু ফাহিম জানে তাকে একটা কথা বলতেই হবে। যতো কষ্টই হোক তাকে বলতেই হবে।
ফাহিম প্রচণ্ড ধরা গলা উপেক্ষা করে সমস্ত আবেগ, বিশ্বাস, ভালোবাসা, একত্রিত করে কম্পিত শরীরে বললো,"আমাকে ক্ষমা কোরো অধরা। ক্ষমা কোরো।"
অধরা মুখে কিছু বললো না। শুধু ফাহিমের কাঁপতে থাকা শরীরটাকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
0 Comments