ভাবনায় তুমি | পর্ব-০১ |


বাসর ঘরে ঢুকেই সাগর রাগী সুরে বলে, "শাড়ির আচল এভাবে ফেলে রেখে বুক দেখানোর মানে কি? আর বিয়ের শাড়ি পাল্টানোর দরকার কি ছিল?"


বিয়ের রাতে স্বামীর মুখে এরকম কথা শুনে তিয়াসা অবাক হয়ে যায়। আজই তার বিয়ে হয়েছে সাগরের সাথে। বিয়ের রাতে স্বামীর থেকে এরকম কথায় চমকে ওঠাটাই স্বাভাবিক। 


সন্ধ্যার কিছু পরে সে এই বাসায় এসেছে। তখন থেকে একটা রুমে একাই বসে আছে। সাগরের আসার নামগন্ধ নেই। মাঝে কয়েকবার অবশ্য এ বাড়ির লোকজন এসেছে। নানাজনে নানা কথাও বলেছে। সাগরের বোন কিছুক্ষণ আগে এসে বলে গিয়েছিলেন শাড়ি পাল্টে সাধারণ শাড়ি পরতে। সে কথামতোই তিয়াসা শাড়ি পাল্টেছে। আর একা বসে থাকতে থাকতে কখন শাড়ির আচল সড়ে গেছে খেয়াল করেনি। 


আমতা আমতা করে তিয়াসা বলে, "আপু একটু আগে বলেছিলেন শাড়ি পাল্টাতে। এজন্য। "


সাগর আবারও রাগী গলায় বলে, "বিয়ে তো আপু করেনি যে আপুর কথায় সব চলবে।"


তিয়াসা এবার অবাক হয়ে যায়। কি বলবে বুঝতে পারে না। বাসর রাত নিয়ে প্রত্যেকটা মেয়েরই স্বপ্ন থাকে। তিয়াসার মনে হতে থাকে তার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তার বাবা মা জোর করেই তাকে এই বিয়েতে বাধ্য করেছে। সাগররা ধনী, সে তুলনায় তিয়াসাদের কিছুই নেই। তারপরও সাগরের পরিবার এই বিয়েতে রাজি হয়েছে কারণ সাগরের প্রথম স্ত্রী মারা গেছে। তিয়াসা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তিয়াসা কখনোই এই বিয়েতে রাজি হত না। কিন্তু সেদিন তিয়াসার বাবা তাকে এসে বলে, "বয়স তো বাড়তেই আছে। আর কতকাল বাপেরটা খাবি? এবার জামাইয়েরটা খেয়ে বাপকে একটু নিস্তার দে।"


তিয়াসা অনেকক্ষণ চুপ করেছিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বাবাকে বলে, "বাবা আমি কি এমন করেছি যে আমার থেকে নিস্তার চাচ্ছো?" 


তিয়াসা বাবার মন গলাতে পারেনি। বলেছিলেন, "মেয়ে বড় হলে বিয়ে করবে এটাই স্বাভাবিক। তুই রাজি হবি না কেন?"


-"হ্যা এজন্য আমার চেয়ে দশ বছরের বড় একজনের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তার কাছে পাঠিয়ে নিস্তার পেতে চাচ্ছো তো? ঠিক আছে। আমি বিয়েই করব। নিস্তার দিব তোমাদের।"


এরপর তিয়াসার সাথে বিয়ে হয় সাগরের। বিয়ের প্রথম রাতেই তিয়াসা বুঝতে পারে কোথায় এসে পরেছে সে? সারাজীবন হয়তো স্বামীর গঞ্জনাই সহ্য করে যেতে হবে। সে যে দ্বিতীয় স্ত্রী! 


সে রাতে সাগর তিয়াসার সাথে আর কোনো কথা না বলেই ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়ে। তিয়াসা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে না পেরে বিছানার আরেক পাশে শোয়। তখনই সাগর চিৎকার দিয়ে উঠে, "এখানেই কেন? ঘরে কি জায়গা কম আছ?"


তিয়াসা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, "তাহলে কোথায় ঘুমাবো?"


- "বাসায় অনেকগুলো রুম আছে। যেখানে ইচ্ছা যাও। কিন্তু আমার বিছানায় না।"


- "আপনি যদি একটু কষ্ট করে বলে দিতেন কোথায় থাকবো তাহলে ভালো হত। আমি আগে আসিনি তো কখনো তাই চিনি না।"


- "আজকে পারব না। পারলে সোফায় ঘুমাও। কষ্ট হলে নিচেও থাকতে পার। কালকে দেখিয়ে দিব কোথায় থাকবে।"


এটুকু বলেই সাগর কাথা দিয়ে মাথা ঢেকে ঘুমিয়ে যায়। তিয়াসা আর সাহস পায়নি সাগরকে ডাকার।


সাগর ঘুমানোর পর তিয়াসা সোফায় গিয়ে বসে। হঠাৎ করেই কেন যেন মরে যেতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে এ পৃথিবীতে তিয়াসার আর প্রয়োজন নেই। নাহলে কেনই বা তার বাবা মা তাকে জোর করে একজনের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পাঠাবে আর কেনই বা সে স্বামীর সাথে শোয়ার অধিকার পাবে না? কি এমন পাপ করেছিলো সে যার জন্য তাকে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে? তিয়াসা নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না। শত চেষ্টায়ও যেন চোখের জলে বাঁধ দিতে পারছে না। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি তিয়াসার শাড়ি পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে। তিয়াসা এবার উঠে বারান্দায় চলে যায়। জানা তো নেই, যদি কান্নার শব্দে সাগর উঠে যায় তাহলে আবার কি করে বসে? 


সারারাত বারান্দাতেই কাটিয়ে দেয় তিয়াসা। বারান্দার গ্রিল ধরে সারারাত যত চোখের পানি ফেলেছে এত পানি মনে হয় সারাজীবনেও ফেলেনি। তবু কাউকে অভিশাপ দেয়নি সে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা মাকেও না, বিয়ের প্রথম রাতেই রুঢ় আচরণ করা স্বামীকেও না। বরং কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করেছে যাতে সৃষ্টিকর্তা তার জীবনটাই কেড়ে নেন। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজের স্বপ্নগুলো বিসর্জন দিয়ে, জগতের মায়া ত্যাগ করে মরে যাওয়াও ভালো। 


এভাবে কখন যে রাত কেটে যায় তিয়াসা টেরও পায় না। ফজরের আযান শুনে বুঝতে পারে সে। ঘরে এসে অযূ করে নামাজ পড়ে। এরপর আবার বারান্দায় যায়। কিছু তো আর করার নেই। এদিকে সাগর তো ঘুমাচ্ছেই।


আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফোটে। কালো আকাশ ফর্সা হতে থাকে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে যায় চারপাশ। ঢাকা শহরের সকালও যে এত সুন্দর হতে পারে এটা তিয়াসার ধারণার বাহিরে ছিল। তিয়াসা ভাবে তার জীবনের অন্ধকারও যদি এভাবে কেটে যেত! যদি সেও সুন্দর একটা জীবন পেত! সুন্দর একটা সংসার পেত! এটা কি এতই অসম্ভব? অসম্ভব কিছুই না। কিন্তু সম্ভবই বা হবে কিভাবে?


কিছুক্ষণ পর সাগর ঘুম থেকে উঠে। তিয়াসা বারান্দায় ছিল, খেয়াল করেনি। সাগর বারান্দায় এসে তিয়াসাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, "সকাল সকাল এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে সবার সামনে দেখানোর মানে কি? আমার ঘরে কি জায়গা দেইনি নাকি যে বারান্দায় এসে নিজেকে এভাবে প্রদর্শন করতে হবে?"


তিয়াসার খুব ইচ্ছা হল বলে, স্বামীর বিছানায় শোয়ার অধিকার দেননি মানেই তো ঘরে থাকার জায়গা দেননি। কিন্তু আর বলে না। না জানি এটা শুনে সাগর আরো কি কি করবে!


তিয়াসাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাগর আরো জোরে বলে, "একবার বললাম কথা কানে যায় না?"


তিয়াসা আর কিছু না বলে ঘরে যায়। সাগর বাথরুমে যায় ফ্রেশ হতে।


সাগর বাথরুমে যাওয়ার পর তিয়াসা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখে সাগরের মা কাজ করছেন। তিয়াসা এগিয়ে এসে বলে, "মা আমি সাহায্য করি?"


সাগরের মা ঘুরে তাকিয়ে বলেন, "না না আমি করছি। রাতে তোমার কোনো সমস্যা হয় নি তো?"


তিয়াসা একবার ভাবলো বলে, "যে ছেলে তার স্ত্রীকে নিজের সাথে থাকতে দেয় না তার সাথে সমস্যা কি হবে?" কিন্তু সেরকম কিছু না বলে হাসিমুখেই বলে, "না মা কোনো সমস্যা হয়নি। "


সাগরের মা একটু সন্দেহের দৃষ্টিতেই তাকালেন যেন। মনে হয় আশা করছিলেন তিয়াসা একগাদা সমস্যার কথা বলবে। সেরকম কিছু না হওয়ায় একটু অবাকই হয়েছেন। কিন্তু সেজন্য কিছু বললেন না। তিয়াসাকে বললেন, "আচ্ছা তুমি যাও। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।"


- "মা আমিও আপনাকে সাহায্য করি? তাহলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। "


সাগরের মা এবার হাসিমুখে সায় দিলেন। তিয়াসা জিজ্ঞাসা করে, "উনি কি পছন্দ করে কিছুই তো জানি না। সকালে নাস্তা খান কখন?"


- "সাগরের কথা বলছো তো? ও সকালে এক কাপ কফি খায়। এরপর নাস্তা খেয়েই অফিসে চলে যায় আটটার মধ্যে। "


- "এখন কি তাহলে কফি দিব?"


- "হ্যা দাও।"


তিয়াসা খুঁজে খুঁজে সব বের করে কফি বানায়। এরপর সাগরের রুমে নিয়ে যায়। সাগরের দিকে কাপ এগিয়ে দিয়ে বলে, "আপনার কফি।"


সাগর না নিয়েই জিজ্ঞাসা করে, "কে বানিয়েছে এটা?"


তিয়াসা ভয়ে ভয়ে বলে, "আমি।"


সাগর এবার চিৎকার দিয়ে বলে, " কে তোমাকে সাহস দিয়েছে আমার জন্য কফি বানানোর? আমি বলেছিলাম?" 


সাগরের চিল্লাচিল্লিতে সাগরের মা এসে জিজ্ঞাসা করেন, "কি হয়েছে সাগর? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?"


সাগর তার মাকে বলে, "ওর সাহস হয় কি করে যে আমার জন্য কফি বানিয়ে আবার আমাকে দেয়? কে এত সাহস দিয়েছে ওকে?"


- "কি যা তা বলছিস? তোর বউ তোকে দিলে দোষের কি আছে? এজন্য এভাবে চিৎকার করবি নাকি?"


সাগর আরো উচ্চস্বরে বলে, "কিসের বউ? তোমরা নিজেরা আমার বউ বানিয়ে দিয়েছো। আমি বলেছিলাম ওকে আমার বউ হতে?"


তিয়াসা এ কথা শুনে আর ধরে রাখতে পারে না। দু'হাতে মুখ ঢেকে সবার সামনেই কাঁদতে শুরু করে। সাগর যেন আরো ক্ষেপে যায় - "এভাবে ফিচফিচ করে কাঁদার মত কিছু বলিনি৷ কাঁদতে মন চাইলে অন্য কোথাও গিয়ে কাঁদো। আমার সামনে এত ঢঙের দরকার নেই।"


সাগরের মা তিয়াসাকে সাগরের রুম থেকে নিয়ে আসেন। তিয়াসাকে অন্য রুমে বসিয়ে সাগরকে নাস্তা দেন। সাগর নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে যায়। এর মাঝে তিয়াসা আর সাগরের রুমে যায়নি। একা একাই চোখের পানি ফেলেছে। 


সাগরকে বিদায় দিয়ে সাগরের মা তিয়াসার কাছে আসেন। তিয়াসা তখনও কাঁদছিলো। তিয়াসাকে আদর করে বলেন, "তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছিলে এটা আগেই বুঝেছিলাম। "


তিয়াসা অবাক হয়ে তাকায়। সাগরের মা বলেন, "বললে না যে রাতে কোনো সমস্যা হয়নি? হয়েছে তো জানি। কি হয়েছে সেটা বল।"


তিয়াসা কান্নার দমকে কথাই বলতে পারছিল না। সাগরের মা তিয়াসাকে বলেন, "দেখ মা তোমার মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস সাগরকে তুমিই ঠিক করতে পারবে। আর তোমার যদি কোনো কষ্ট হয় তাহলে তুমি আমাকে বল কিন্তু সাগরকে কিছু বলতে যেওনা। "


তিয়াসা এবার শ্বাশুড়িকে প্রশ্ন করে, "আচ্ছা মা উনার কি হয়েছিল বলবেন কি? আমি আসলে হুট করেই বিয়েটা করে ফেলেছি। কোনো প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই। তাই তেমন কিছুই জানি না।"


- "হ্যা অবশ্যই। স্ত্রী হিসেবে তোমার তা অবশ্যই জানা উচিত। "


সাগরের মা তিয়াসাকে পাশে বসিয়ে বলতে শুরু করলেন। 


চলবে...

Post a Comment

0 Comments