আমার মায়ের যখন দ্বিতীয়বার বিয়ে হলো তখন আমার বয়স মাত্র সাত বছর আর ছোট বোন মিতুর বয়স তিন বছর। আমার আসল বাবা আমার মা কে ডিভোর্স দিয়ে পুনরায় বিয়ে করেছেন যখন মিতুর বয়স এক বছর মাত্র। এই দুই বছর মা আমাদের নিয়ে নানাবাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু নানা নানি কেউ বেঁচে না থাকলে যা হয়। দুই মামা আমাদের মোটামুটি ভালোবাসলেও মামিরা কখনো আমাদের ভালো চোখে দেখেননি। আমাদের সবসময় বোঝা মনে করতেন তারা। এমন না যে আমার মামারা গরীব। অনেক রোজগার তাদের,কিন্তু তাও আমরা তিনটা মানুষ যেনো দিনের পর দিন চোখের বালি হতে থাকলাম মামিদের কাছে। মামারা কিছুটা ভালোবাসলেও বিপত্তি বাঁধে তখন, যখন মামিদের আমাদের উপর রাগ দেখে মা তার পৈতৃক সম্পত্তি থেকে নিজের ভাগ বুঝে নিতে চান। আমার নানা ছিলেন জজ কোর্টের উকিল। তিনি তার জীবদ্দশায় অনেক জমি-জমা কিনে রেখেছিলেন। দিন যতো যায়, সেসব জমির দাম ততো বাড়তে থাকে। নানা তার তিন ছেলেমেয়েকে সমানভাবে সেসব সম্পত্তি লিখে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেরকম কাগজপত্রও জমিজমা সংক্রান্ত উকিলকে ডেকে ঠিক করেছিলেন অনেকটা। কিন্তু সবকিছু চুড়ান্তভাবে ঠিকঠাক হওয়ার আগেই নানা হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক করে পরলোকগমন করেন। মামারা তখন খুব চালাকির সাথে সেসব কাগজপত্র সরিয়ে ফেলেন। এসব অবশ্য আমরা অনেক পরে জানতে পারি।
কিন্তু মা যখনই তার ভাগের সম্পত্তি বুঝে নিতে চান, মামাদের আসল রূপ বেরিয়ে আসে। আমাদের সামনেই মা কে যা নয় তাই বলে অপমান করতে থাকে। আমার তখন একদম কচি বয়স, মিতু তো আরো ছোট। মায়ের অপমান দেখে চোখে পানি চলে আসে আমাদের। এতোদিন মামিরা আমাদের সহ্য করতে না পারলেও মামাদের ভয়ে মুখ খুলতেন না বেশি। কিন্তু যখনই মামারাও মা কে যা নয় তাই বলতে থাকেন, তখন মামিরাও চুপ করে থাকেন না আর।
বড় মামি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলেন,"দেখেছো দেখেছো। এইজন্য বলেছিলাম বেশি বাড়তে দিও না তোমার বোনকে। এতোদিন আমরা না দেখলে কোথায় যেতো ও? বর তো ফেলে রেখে আরেকটা বিয়ে করেছে। দুই মেয়ে নিয়ে আমাদের ঘাড়ে এসে উঠেছে। এখন আবার সম্পত্তির ভাগ চায়। আরে বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা আবার বাপের বাড়ির সম্পত্তি পায় নাকি? এতোদিন এমন ছিলো না। দুইদিন বাইরে যাচ্ছে, দুটো টাকার মুখ দেখেছে ওমনি ভাইদের মুখের উপর সম্পত্তি দাবী করে বসেছে।"
বলে রাখা ভালো, মা ততদিনে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোটখাটো একটা চাকরি নিয়েছেন।
ছোট মামিও চুপ করে থাকেন না। চিৎকার করে বলতে থাকেন,"আমাদের শ্বশুরমশাই কি তার কোনো সম্পত্তিতে মেয়েকে ওয়ারিশ করে রেখে গেছেন? যান নি তো। তাহলে তো সেসব দলিলপত্র থাকতো। তাহলে কিসের ভাগ পাবে ও? এতোদিন যে আমরা তিনজনকে খাওয়ালাম পরালাম, কোন মুখে আবার সম্পত্তির ভাগ চায় বুঝিনা আমি।"
মা অসহায়ের মতো ভাইদের দিকে তাকান। তার বিশ্বাস ছিলো তার ভাইরা প্রতিবাদ করবে। কিন্তু মা কে অবাক করে দিয়ে বড় মামা বলেন,"হ্যা সুরভি(আমার মায়ের নাম), ওরা ঠিক কথাই বলেছে। বাবার কোনো দলিলপত্রে তোমার নাম নেই। আর বাবার আছেই বা কি। অল্প কিছু জায়গাজমি। যার বেশিরভাগ আমি আর ছোটন(আমার ছোট মামা) অনেক আগেই বেঁচে দিয়েছিলাম বাবার বিভিন্ন দেনা শোধ করতে।"
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তিনি জানতেন তার বাবা কখনো কোনো দেনা রাখেননি, আর কম জমিজমাও করেন নি। ভাইদের এমন ব্যবহার দেখে মায়ের দুইচোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে। সেদিন রাতে মা আমাদের জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেন।
কিন্তু তার পর থেকে শুরু হয় আমাদের উপর মামিদের অকথ্য বাজে ব্যবহার। আগে মামাদের ভয়ে খুব বেশি বলতেন না। কিন্তু এখন মামারাও আমাদের সহ্য করতে পারেননা। তাই বেশি সুযোগ পেয়ে যান তারা। কথায় কথায় মা কে অপমান করতো তারা। আর মা অফিসে গেলে আমাকে দিয়ে অনেক কাজ করাতো। আমার বয়স তখন কতোই বা, অতো ভারী কাজ কি আর আমি পারতাম?কিন্তু তাও মা কে কিছু বলতাম না আমি। মায়ের যা বেতন তা দিয়ে আলাদা ঘর ভাড়া করে আমাদের নিয়ে থাকা সম্ভব না। তাই এখানেই পড়ে থাকতে হবে আমাদের। এতোটুকু বয়সেই এসব বুঝ আমার চলে এসেছিলো।
কিন্তু সমস্যা হয় সেদিন। বড় মামি আমাকে গরম ভাতের হাড়ি থেকে ফ্যান ঝরাতে বলেন। এই কাজ আমি কোনোদিন করিনি। কিন্তু মামি যখন বলেছেন আমাকে করতেই হবে। আমি খুব সাবধানে হাঁড়ি উপুড় করার চেষ্টা করি। কিন্তু অতো ভারী হাঁড়ি উপুড় করে ফ্যান ঝরানো কি আর আমার কাজ? সোজা এসে গরম ভাত এসে পড়লো আমার হাতে। গগনবিদারী চিৎকার করে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ি আমি। যখন জ্ঞান ফেরে আমি দেখি মা আমার মাথার কাছে বসে কাঁদছে আর জলপট্টি দিচ্ছে। আমার হাত তখন প্রায় অবশ, তাকিয়ে দেখি হাতে ব্যান্ডেজ করা। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কোনোরকমে মা বলে ডাক দিই। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেন। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি।
এরপরের কিছুদিন মা খুব চুপচাপ ছিলেন। আমাদের সাথেও খুব বেশি কথা বলতেন না। অফিস থেকে এসে বারান্দায় চুপ করে বসে থাকতেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। আমরা সাহস পেতাম না মা কে কিছু জিজ্ঞেস করার। কিন্তু আমার এতো বড় একটা দুর্ঘটনার পরও আমার মামারা কেউ মামিদের কিছু বলেননি। ছোট্ট মনে খুব কষ্ট ছিলো আমার এটা নিয়ে। হঠাৎ একদিন মা আমাকে আর মিতুকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে বাইরের ঘরে চলে গেলেন মামাদের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলতে। মা খুব কড়া গলায় কথা বলছেন শুনতে পেলাম। মা কে এতো শক্ত গলায় কখনো কথা বলতে শুনিনি। আমি মিতুকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে থাকলাম, বেশ ভয় করতে লাগলো আমাদের। মামাদের আওয়াজ তেমন শুনলাম না, তবে মামিরাও কি যেনো বলছিলেন শুনলাম। কিন্তু মায়ের কঠোর আওয়াজের কাছে তা কিছু না। এর প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর মা ঘরে এসে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেন। মা কে এতো রাগতে কখনো দেখিনি আমরা। মা হঠাৎ আমাদের পাশে এসে বসলেন। আমাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর হঠাৎই ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কথা জড়িয়ে যায়। তাও কোনোমতে বললেন,"তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও মা, ক্ষমা করে দিও।"
কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, মা ক্ষমা কেনো চাচ্ছে? আর কেনোইবা এভাবে কাঁদছে? কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, কারণ মায়ের মন খুব খারাপ বুঝলাম। তাই আমি আর মিতু চুপ করে মা কে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম।
এরপরদিন থেকে মামিদের ব্যবহার হঠাৎ পরিবর্তন। আমি কোনো কাজ করতে গেলে মামিরা দৌড়ে এসে আমাকে বাঁধা দেয়। খাওয়ার সময় আমাদের ভালো ভালো খাবার দেয়। সেদিন আবার বড় মামি আমার আর মিতুর জন্য নতুন জামাও কিনে আনলেন। এতো যত্নের কোনো কূলকিনারা করে উঠতে পারলাম না। সেদিন খাওয়ার সময় ছোট মামি আমার পাতে মাছের মাথাটা তুলে দিলে আমি বলি,"মামি এতো বড় মাছের মাথা আমি খেতে পারবো না। আমাকে ছোট একটা মাছ দিলেই হবে।"
মামি কিঞ্চিৎ মন খারাপ করে বললেন,"আর কয়দিনই বা এই বাড়িতে আছিস তোরা। এখন যদি একটু ভালোমন্দ খাওয়াতে না পারি, পরে আফসোস থাকবে। বড়লোক বাবা পেয়ে কি আর এই গরীব মামা-মামি দের মনে রাখবি রে?"
আমি অবাক হয়ে মামির দিকে তাকালাম। মামি এসব কি বলছে? এই বাড়ি কোথায় যাবো আমরা? আর বড়লোক বাবা? তার মানে কি আমাদের বাবা আমাদের ফিরিয়ে নিতে চান? কিছুই মাথায় ঢুকলো না আমার। ফ্যালফ্যাল করে মামির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এরপরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুত ঘটে যায় কীভাবে যেনো, আমরা বুঝতেই পারলাম না। হঠাৎ একদিন মামিরা এসে আমাকে জানায় আমার মা নাকি আবার বিয়ে করবে। তার অফিসের বড় স্যারকে। আমি তখন বুঝিনা এসব ঠিকমতো। মা আমাদের এই বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে এটা বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু মা আবার বিয়ে করবে এ ধরনের ব্যাপার আগে বুঝিনি। বিয়ে বলতে বছর দুই আগে দেখেছিলাম, বাবা বিয়ে করে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো। আচ্ছা তাহলে মা বিয়ে করেও কি আমাদের তার কাছে থাকতে দিবে না? ক্রমেই ভয় আমার বুকের মধ্যে বাসা বাঁধে। মিতু তখন খুবই ছোট, এসব বোঝার মতো বয়স হয়নি। সে একমনে বসে পুতুল নিয়ে খেলছে। আমি ছুটে যেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি। মা তখন অফিসে। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত সব জানতেও পারছি না। ততক্ষণে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে। মা ও যদি আমাদের তার কাছে থাকতে না দেন, আমরা কোথায় যাবো তখন?
সন্ধ্যার অনেকক্ষণ পর মা বাড়িতে আসলেন অনেক কেনাকাটা করে নিয়ে। এসেই হৈচৈ করতে শুরু করলেন। আমাদের জন্য অনেও নতুন জামা আর খেলনা এনেছে মা। মিতু খুশিতে পাগলপ্রায়। অন্যদিন হলে আমিও খুশি থাকতাম। কিন্তু আজকে আমার ভিতরে অন্য ভয় কাজ করছে। আমি চুপ করে একপাশে বসে থাকলাম। আমাকে অনেকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে মা আমার কাছে আসেন। আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,"রিতু মা, তোমার কি মন খারাপ?"
আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে থাকলাম। মা এবার আমার সামনে বসে বললেন,"কি হয়েছে রিতু? আমাকে বলো। মামিরা কিছু বলেছে তোমাকে?"
আমি আস্তে করে বললাম,"মা, তুমিও কি বাবার মতো আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?"
মায়ের মুখ সাথে সাথে অন্ধকার হয়ে গেলো। শক্ত গলায় বললেন,"মানে? কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো।
"মামি বললো তুমি নাকি আবার বিয়ে করবে? কিন্তু বাবা বিয়ে করে তো আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। তুমিও বিয়ে করবে, তার মানে তুমিও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।"
এই বলে ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম আমি। মা আমাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললেন,"রিতু, আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো না তোমার বাবার মতো। আমি তোমাদের আমার সাথে নিয়ে যাবো।"
আমি চোখ মুছে মায়ের দিকে তাকালাম। খুশি হয়ে বললাম,"সত্যি বলছো মা?"
মা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,"হ্যা সত্যি। আমার দুই রাজকন্যাকে ছেড়ে আমি কি থাকতে পারি?"
ভীষণ খুশি হলাম আমি। যাক, তাহলে বিয়ে মানেই ছেড়ে যাওয়া নয়। খুশি হয়ে আমিও মিতুর সাথে খেলতে গেলাম।
এর কিছুদিন পর একজন কোর্টটাই পরা আঙ্কেল এলেন আমাদের বাড়ি। এসেই খুব আদর করলেন আমাকে আর মিতুকে। আমার তো খুব পছন্দ হলো উনাকে। আর মামিরাও দেখলাম বেশ আপ্যায়ন করছে উনাকে। বড় কালো গাড়িতে করে এসেছেন উনি। আমাদের জন্য অনেক উপহার এনেছেন। কি ভালো আঙ্কেলটা। আমার ভীষণ ভালো লাগলো উনাকে। বড় মামি আমাকে ডেকে নিয়ে বললো,"উনাকে চিনেছিস তো রিতু? উনি তোদের নতুন বাবা হতে যাচ্ছে রে।"
আমি অবাক হয়ে বললাম,"বাবা আবার নতুন পুরোনো হয় নাকি? আর আমাদের বাবা তো আরেকজন, উনি আমাদের বাবা হতে যাবেন কেনো?"
"আরে বোকা মেয়ে। উনাকেই তো তোর মা আবার বিয়ে করবে। তার মানে উনিই তোদের নতুন বাবা।"
"বাহ ভারী মজা তো। আমরা আবার বাবা পাবো।"
মামি মুখ ভেঙচি দিয়ে বললেন,"মজা না ছাই।এখন থেকে তোদের মজার দিন শেষ। এইযে এতো ভালো ব্যবহার করছে সব লোক দেখানো। বিয়ের পর তোদের মা কে তোদের থেকে আলাদা করে দিবেন উনি। তোদের কষ্ট দিবেন। নতুন বাবা কখনো আপন হয়না রে,বুঝলি?"
আমার বুক কেঁপে উঠলো। এসব কি বলছে মামি? মা কে আমাদের কাছে থাকতে দিবেন না? আমাদের কষ্ট দিবেন? কিন্তু মা সবকিছু কেনো মেনে নিবেন? আমি ছলছল চোখে মামির দিকে তাকালাম।
"আমি যাই রে, অনেক কাজ পড়ে আছে। আমি যে এসব বলেছি তোকে কাউকে বলিস না।" এই বলে মামি চলে গেলেন। সেদিন আর আমার দুশ্চিন্তা গেলো না।
এর সপ্তাহ খানিক পরে খুব সাধারণ ঘরোয়া ভাবে আমার মায়ের বিয়ে হয়ে যায় ওই আঙ্কেলটার সাথে। বিয়েতে খুব বেশি মানুষ আসেনি। আঙ্কেলের সাথে অল্প কিছু মানুষ আর আমরা বাড়ির কয়েকজন। খাওয়া দাওয়ার পরেই সেই গাড়িটায় করে আমাদের নিয়ে চলে গেলো আঙ্কেল। যাওয়ার আগে মামিরা অনেক কাঁদলো আমাকে আর মিতুকে জড়িয়ে ধরে। আমরাও চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। যতোই হোক এতোদিন একসাথে ছিলাম।
আঙ্কেলের বাড়ি এসে তো আমি অবাক। এতো বড় বাড়ি আগে কখনো দেখিনি আমি। মিতু তো খুশিতে সারাবাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে খচখচ করেই যাচ্ছে। মামি যেটা বললো তা যদি সত্যি হয়? আমাদের মায়ের থেকে আলাদা করে দেয় যদি?
যদিও আঙ্কেলটা আসার পর থেকে অনেকবার খোঁজ নিচ্ছেন আমাদের। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, কিছু লাগবে কিনা। আমি চুপ করে মায়ের কাছে বসে আছি। আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছি নতুন আঙ্কেলটা আসলে খারাপ না। আমি মাত্রই একটু সহজ হতে শুরু করেছি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে রাতে।
আমাদের জন্য নতুন ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু আমি বা মিতু মা কে ছাড়া ঘুমাতে পারিনা। আজ থেকে নাকি মা আমাদের সাথে ঘুমাবেন না। আমাদের সাথে একজন গৃহকর্মী থাকবেন। শুনেই আমি মামির কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে ফেললাম। তাই তো, প্রথম দিন থেকেই লোকটা আমার মা কে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে আমাদের থেকে। আমাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করছে কিন্তু ঠিকই আমাদের থেকে মা কে কেড়ে নিচ্ছে। মা ও কি সুন্দর আমাদের কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলো উনার সাথে। সে রাতে আমার ঘুম হলো না। মিতু যদিও মা কে ছাড়া একটু মন খারাপ করছিলো। কিন্তু গৃহকর্মীটা তাকে অনেক গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেছে। আমি ঘুমাতে পারলাম না। সারারাত বালিশ ভিজিয়ে কাঁদলাম।
সকাল হতেই দেখলাম মা অনেক খুশি। অনেকরকম নাস্তা বানিয়েছে। সুন্দর একটা শাড়ি পরে সারা ঘরে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে মা কে! কিন্তু কেনো জানি একরাতেই মা কে কেমন অপরিচিত লাগছে আমার কাছে। মনে হচ্ছে আগের সেই মা আর নেই আমার। এই সময় তো মা তৈরি হয়ে অফিসে চলে যায়। নাস্তার টেবিলে এসে বসলাম। মা আমাদের নাস্তা এগিয়ে দিলেন। আরেকটা প্লেটে সুন্দর করে নাস্তা রেডি করছেন। আমার মনে হচ্ছে এতো যত্ন করে আমাদের নাস্তা তৈরি করেনি মা। রাগে আমার শরীর জ্বলতে থাকলো। এক পর্যায়ে ওই আঙ্কেলটাও এসে টেবিলে বসলো। কেনো জানি খুব রাগ লাগছে উনাকে দেখে,সহ্য করতে পারছি না। অনেক কষ্ট করে চুপ করে থাকলাম। আমাদের দেখেই উনি বললেন,"মায়েরা,তোমাদের ঘুম হয়েছে তো ভালো? কোনো সমস্যা হয়নি তো?"
আমি উত্তর দিলাম না। না শোনার ভান করে নাস্তা করতে লাগলাম। লোকটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মা একটু কঠিন সুরে বললো,"রিতু, বাবা কি বলছেন শুনতে পাওনি?"
আমি অবাক হয়ে বললাম,"বাবা? কে বাবা?"
দেখলাম লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মা তো চোখ লাল করে তাকালো আমার দিকে। আমার কান্না চলে আসলো। তাই তো, মামি ঠিকই বলেছে। মা কোনোদিন এমন ভাবে আমাদের দিকে তাকায়নি। এই লোকটার জন্য মা বদলে যাচ্ছে।
মা গলার স্বর আরো কঠিন করে বললেন,"উনি তোমাদের বাবা। আজ থেকে উনাকে বাবা বলে ডাকবে তোমরা।"
লোকটা আস্তে আস্তে বললেন,"থাক না সুরভী, ওদের যেটা ডাকতে ভালো লাগবে ওরা তাই ডাকুক। বাচ্চাদের উপর এভাবে জোর করা ঠিক না।"
মনে মনে ভাবলাম,"আমার মা কে আমাদের থেকে কেড়ে নিয়ে খুব ভালোমানুষ সাজা হচ্ছে তাইনা?"
নাস্তার প্লেট ঠেলে সরিয়ে উঠে গেলাম আমি। মা কে উদ্দেশ্য করে বললাম,"উনি আমার বাবা না। আমার বাবা অন্য কেউ। আর কাউকে আমি বাবা বলে ডাকবো না।"
এই বলে একছুটে ঘরে চলে আসলাম আমি। মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
সেইদিন থেকে মায়ের সাথেও দূরত্ব সৃষ্টি হয় আমার। আমি আস্তে আস্তে জেনেছি, লোকটা আমার মায়ের অফিসের বস ছিলেন। উনার আগের স্ত্রী উনাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। আত্মীয়স্বজন সবাই বাইরের দেশে থাকে। মা কে অফিসে দেখে ভালো লাগায় তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মা প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু মামা মামিদের অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত রাজি হন। মা কে বিয়ে করার আগে নাকি দত্তকও নিয়েছেন আমাদের। দিনদিন আমার মনে হচ্ছিলো এর থেকে মামা মামির অত্যাচারই ভালো ছিলো। অন্তত আমাদের মা তো আমাদের ছিলো। এখন মা যাই করে আমার মনে হয় মন থেকে করে না। মায়ের সবকিছু এখন ওই লোকটা। আমরা কিছুই না। কিন্তু ওই লোকটা এমন ভাব করে যে আমাদের অনেক ভালোবাসে। অনেক খেলনা, জামাকাপড় এনে দেন আমাদের। কিন্তু তাও উনাকে সহ্য হতো না আমার। সবসময় চেষ্টা করতাম মায়ের থেকে উনাকে কীভাবে আলাদা করা যায়। কোনোভাবেই পারছিলাম না। প্রায়ই আমাদের বাইরে খেতে নিয়ে যেতে চান উনি। আমি যাইনা কখনো। অনেক জোর করেন আমাকে,কিন্তু আমার ভালো লাগে না। মিতুকেও আমি জোর করে আটকে রাখি। অনেক রাতে মা আর উনি হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরেন। আমাদের জন্যও প্যাকেট করে আনেন খাবার। কিন্তু ওই হাসির শব্দ অসহ্য লাগে আমার। সবসময় ভাবতে থাকি কীভাবে মায়ের থেকে উনাকে আলাদা করা যায়।
চলবে.......


0 Comments