বাবা| শেষ পর্ব



দিন দিন মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা শুধু খারাপের দিকেই যাওয়া শুরু করেছে। মা যতই আমাকে কাছে টানতে যান ততই আমি আরো দূরে সরে যাই। কারণ আমি চিন্তা করি যে, মাকে হয়তো ওই লোকটা আমাদের থেকে একদমই আলাদা করে নিয়ে গেছে। লোকটা আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় ও অভিনয় করছে। আমাদের মা কে আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। মিতু ছোটমানুষ।  ও এতো কিছু বোঝে না। ওই লোকটা যখন অনেক খেলনা আর চকলেট এনে দেয়,ও সব ভুলে যায়। সবাইকে আমার থেকে দূরে সরে যেতে দেখে আমার খুব অসহায় লাগে নিজেকে।

এভাবেই দিনগুলো চলে যাচ্ছিলো। আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার মায়ের আবারও একটা মেয়ে হয়। মা একদম ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে। আজকাল মিতুর খোঁজও মা নেয় না খুব একটা। একজন গৃহকর্মীর কাছেই বড় হতে লাগলাম আমরা দুইবোন। স্কুলে কি টিফিন নিয়ে যাবো তা দেখার পর্যন্ত সময় নেই মায়ের এখন। রাগে আমি টিফিন পর্যন্ত নিই না। ওই লোকটা যদিও আগের মতোই আমাদের খোঁজ নেয়। তাও আমার অসহ্য লাগে উনাকে। এসব কিছুর জন্য উনি দায়ী। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে দু চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যেতে,শুধু মিতুর জন্য যেতে পারিনা। কতো ইচ্ছা ছিলো বড় একটা চাকরি করবো, তারপর অনেক বড় একটা বাড়ি বানাবো। সেই বাড়িতে আমি,মা আর মিতু থাকবো। মা কে আর মামাদের বাড়ি থাকতে হবে না। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো। এই বাজে লোকটা এসে মা কে আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে দিলো। এখন আমার মন চায় খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যেতে। যাতে একটা চাকরি করে মিতুকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে পারি।

এরই মধ্যে একদিন দুই মামী এলো আমাদের সাথে দেখা করতে। আমি তখন পড়ছিলাম নিজের ঘরে বসে। যতোটুকু সময় বাড়িতে থাকি আমি পুরোটা সময় নিজের ঘরেই দরজা আটকে বসে থাকি কারণ বাইরে গেলেই মায়ের তার ছোট মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা করা দেখলে নিজেকে সংযত রাখতে পারিনা। 

হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। নিশ্চয়ই ওই লোকটা দুপুরের খাওয়ার জন্য ডাকছে। খুবই বিরক্ত করে মাঝে মাঝে। ঝাঁঝের সাথে দরজা খুলে তাকাতেই দেখি দুই মামী। মামীরা যতোই কষ্ট দিক আমাদের, এই সময় তাদের চেয়ে আপন আমার কাছে কাউকে মনে হয় না। আমি ছুটে যেয়ে বড় মামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করার পর মামীরা আমাকে নিয়ে আমার ঘরে এলো। ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ছোট মামী বললো," বাবাহ, রিতু তো আজকাল রাজার হালে থাকে। কি সুন্দর ঘর সবকিছু সাজানো গোছানো। কতো সুন্দর জামা পরে। গরীব মামীদের তো ভুলেই গেছে এইজন্য।"

আমি মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। এতোসব আভিজাত্যের কোনো দরকার ছিলো না আমার। মা আর মিতুকে নিয়ে ভালোই ছিলাম মামার বাড়িতে আমরা।

"কি রে রিতু,চুপ করে আছিস কেনো? তোর কি মন খারাপ?"

বড় মামী এসে আমার মাথায় হাত রাখলো। ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম আমি এতোদিন পর একটু স্নেহের কথা শুনে।

ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললাম,"জানো মামী,মা না একদম বদলে গেছে।"

"কেনো রে? কি হয়েছে?"

"আগে থেকেই আমাদের দুইবোনের উপর কোনো খেয়াল ছিলো না। তার উপর মায়ের এই নতুন মেয়েটা হওয়ার পর থেকে মা যেনো ভুলেই গেছে আমাদের। আমরা কখন খাই, কি খাই, কখন স্কুলে যাই কিছুই জানে না মা। আমার আর ভালো লাগছে না মামী। আমাকে আর মিতুকে নিয়ে চলো তোমরা।"

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলাম আমি।

দুই মামী হঠাৎ নিজেদের মধ্যে একটু হাসলো। আমি তাদের হাসির অর্থ বুঝতে পারলাম না। ছোট মামী আমাকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,"দিন যাবে আর সব এমনই হবে বরং আরো বেশি হবে।"

আঁৎকে উঠলাম আমি।

"কি বলছো মামী?"

"হ্যা তবে আমরা যেমন বলবো তেমন চলতে পারলে তোর মা ওই লোকের কাছ থেকে দূরে সরে আসবে।"

"সত্যি? সত্যি বলছো মামী?"

"সত্যিই বলছি রে। তবে একটা শর্ত আছে।"

"বলো কি শর্ত? আমি সব শর্ত মানতে রাজি আছি।"

"দ্যাখ আমরা তো তোর ভালোই চাই। ছোট থেকে আমাদের কাছে বড় হলি তোরা। তোর এই কষ্ট কীভাবে দেখি বল। তাই যে বুদ্ধি দিবো তা কিন্তু তুই ছাড়া আর কেউ যেনো না জানে। তাহলে কিন্তু তোর মা তোর থেকে আরো দূরে চলে যাবে।"

"তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো মামী। আমি কাউকে বলবো না। প্রমিজ।"

সেদিন দুই মামী আমাকে এমন একটা প্লান শিখিয়ে দিলো যা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। যদিও এ সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই আমার ছিলো না। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,"কি বলছো মামী?খুব ভয় করছে তো আমার।"

ঠোঁট উল্টিয়ে বড় মামী বললো,"ভয় করছে যখন থাক এমন। তিথি(মায়ের ছোট মেয়ে) আর ওর বাবা যখন তোর মা কে একেবারেই তোর কাছ থেকে নিয়ে যাবে তখন বুঝবি।"

আমি আমতা আমতা করে বললাম,"এতে কাজ হবে তো মামী?"

"একশবার হবে। তুই শুধু কাজ চালিয়ে যা।"

এই বলে দুইজন হাসতে হাসতে আমার ঘর ছেড়ে চলে গেলো। আমি বসে ভাবতে লাগলাম কবে মামীদের প্লান কাজে লাগাবো আমি।

আমি তক্কে তক্কে থাকলাম। কখন সুযোগ পাবো। পেয়েও গেলাম একদিন। ঘটনার দিন মা তিথিকে খাওয়াচ্ছিলেন বারান্দায় বসে। মিতুও সেখানে ছিলো। ওই লোকটা তার ঘরে বসে অফিসের কাজ করছিলো। আমি ভাবলাম এইতো সুযোগ। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে হবে।

আমি পা টিপে টিপে ওই লোকটার পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে যারপরনাই অবাক হলেন উনি। কারণ এর আগে আমি কখনো উনার পাশে এভাবে দাঁড়াইনি। উনি অবাক হয়ে বললো,"কি হয়েছে রিতু মা? কিছু কি বলবে তুমি?"

আমার হৃৎপিণ্ড ধকধক করতে লাগলো। আমি জানিনা কি হবে, মামীরা যা শিখিয়ে গেলেন সেভাবেই কাজ করতে হবে।

আমি হঠাৎ উনার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। উনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, বুঝে উঠতে পারছেন না কি হচ্ছে। 

আমি হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলাম। লোকটা হতবিহ্বল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক পর্যায়ে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেন উনি।

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মা তিথিকে কোলে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তখন ঘরে৷ পিছু পিছু মিতুও এসেছে, তার চোখে ভয়।

মা কঠিন গলায় বললেন,"কি হচ্ছে এখানে রিতু? চিৎকার করছিস কেনো?"

আমি মামীদের শেখানো কথামতো উনার হাত ছেড়ে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে মিথ্যা কান্না শুরু করলাম। লোকটা হতবাক হয়ে আছে, উঠে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে।

আমি ফোঁপাতে ফোপাঁতে মা কে বললাম,"মা মা জানো এই লোকটা আমাকে ব্যথা দিয়েছে।"

মা কেঁপে উঠলো ভয়ানক ভাবে। আর ওই লোকটা আঁৎকে উঠে বললো,"কি বলছো এসব রিতু?"

আমি বললাম,"মা আমি নিজের ঘরে বসে হোম ওয়ার্ক করছিলাম। হঠাৎ উনি আমাকে ডেকে নিয়ে আসলেন এই ঘরে। এসেই আমাকে অনেক জোরে ব্যথা দিলেন।"

এই বলে আরো জোরে কাঁদতে লাগলাম আমি। আমি জানিনা এর মানে কি? মামীরা আমাকে যা যা শিখিয়েছে আমি শুধু তেমনটাই করলাম। কারণ এখন আমার মা কে আমার কাছে চাই, একদম নিজের করে।

লোকটা এতোটাই অবাক হয়েছে যে, কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত পাচ্ছে। কোনোরকমে বললো,"সুরভী বিশ্বাস করো, এমন কিছু....."

কথা শেষ করার আগেই মা চিৎকার করে বললো,"আর একটা কথাও বলবে না তুমি। ছি ছি ছি। তুমি এতোটা নীচ? এই ছিলো তোমার মনে? আমার এতোটুকু বয়সের মেয়েটাকে তুমি এইজন্য এখানে এনেছো? ঘৃণা করছে তোমাকে আমার।ছিহ!"

আমি তো খুশিতে আত্মহারা। যাক, মা এই প্রথম লোকটার সাথে এভাবে কথা বললো। ইশ!মামীদের যদি এখনই জানানো যেতো তবে কতোই না ভালো হতো। খুশিতে একটা লাফ দিতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু না, এখন এতোটা উত্তেজিত হওয়া যাবে না। অনেক কষ্টে মায়ের মনে বিষ ঢালতে পেরেছি, কোনোরকম ভুল করা যাবে না এখন।

"সুরভি বিশ্বাস করো আমাকে....'

" বিশ্বাস? তোমাকে? কি বলতে চাচ্ছো আমার মেয়ে তোমাকে ফাঁসাচ্ছে? এতোটুকু বয়সের মেয়ে, ও বোঝেই বা কি? তুমি সত্যি এই কাজ না করলে ও কীভাবে এমন বলতে পারে?"

লোকটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমার তো খুশিতে পাগল পাগল লাগছে। এতোদিন পরে মা কে আবার কাছে পাবো বলে।

ওই ঘটনার পর থেকে আমি যেনো মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেলাম। মা এখন ওই লোকটার সাথে একঘরে থাকে না। আমি,মিতু,তিথি আর মা একসাথে ঘুমাই এখন। লোকটা সবসময় মাথা নিচু করে চলাফেরা করে বাড়ির মধ্যে। এতো ভালো লাগে আমার। দেখো কেমন মজা লাগে! আমাকে আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে সরাতে চেয়েছিলে না? এবার নিজেই দূরে যাও।


এভাবেই আমাদের দিনগুলো যেতে থাকলো। মায়ের সাথে ওই লোকের সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেলেও কিছু একটা সুরটা কোথায় কেটে গেছে। আমার কাছে অনেকবার তার ক্ষমা চাইতে হয়েছে। খুব ভালো লাগতো তখন আমার। 

দেখতে দেখতে আমি ভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্রী হয়ে গেলাম। তিথি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ে আর মিতু ভার্সিটির প্রথম বর্ষে। লোকটাকে এখনো মেনে নিতে না পারলেও তিথিকে বেশ ভালোবাসি আমি। তিথিও বড় আপা,ছোট আপা বলতে পাগল।


ভার্সিটির প্রথম বর্ষ থেকেই রোহানের সাথে পরিচয় আমার। ও ছিলো আমার এক ব্যাচ সিনিয়র। ওই প্রথম প্রোপজ করে আমাকে। প্রথম প্রথম রাজি ছিলাম না আমি। আমার একটাই লক্ষ্য ছিলো পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি নিয়ে ওই লোকটার বাড়ি ছেড়ে দেওয়া। কখনোই উনাকে বাবা বলে পরিচয় দিই না আমি। কিন্তু তার অন্যসব সুবিধা ঠিকই নিয়ে এসেছি আমি। দামী মোবাইল,ল্যাপটপ। সবসময় দামী জামাকাপড় পরে ভার্সিটিতে যাই গাড়ি চড়ে। ওই লোকের দেওয়া সব সুবিধা নিই কিন্তু উনাকেই সহ্য করতে পারিনা আমি।

রোহান এতো ভালোবাসা, কেয়ার করা শুরু করলো আমি ওকে ভালো না বেসে পারলাম না। শেষে এমন হলো আমি ওর জন্য প্রায় পাগল হয়ে গেলাম। ও ভীষণ গরীব ঘরের ছিলো,প্রায়ই টাকাপয়সার সমস্যায় পড়তো। তখন আমি অনেক সাহায্য করি ওকে। আমি বাড়ি থেকে প্রচুর হাতখরচ পেতাম। তার বেশিরভাগ টাকা ওকেই দিতাম আমি। আমার বেশি টাকার দরকার ছিলো না। যখন যা চাই হাতের কাছে পেতাম, টাকা দিয়ে কি হবে। টাকা পাওয়ার পর রোহান খুশিতে কেঁদে দিতো। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতো,"রিতু দেখো তোমাকে আমি রাজরানী করে রাখবো।"

আমি স্বপালু চোখে তাকিয়ে থাকতাম। সারাজীবন মনের কষ্টে থাকা আমি রোহানের মাঝে নিজের সুখ খুঁজে নিতাম। কতো ভালো দিন গেছে সেসব।

এরই মধ্যে আমি শেষ বর্ষে চলে এলাম। রোহান ততদিনে অনার্স শেষ করে ফেলেছে। ওকে আমি তাগাদা দিতে থাকি চাকরি খোঁজার। কারণ ও চাকরি পেলেই আমাকে বিয়ে করবে আর ওই বাড়ি থেকে চলে যেতে পারবো আমি। কিন্তু ওর মধ্যে চাকরি খোঁজার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না। চাকরির কথা বললেই শুধু বলে,"আজকাল চাকরি করে কোনো লাভ নেই জানো তো। কিছু টাকা হলেই ব্যবসা শুরু করবো।"

আমি বুঝতে পারিনি তখনও ও কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরমধ্যে একদিন ও বললো,"আমার বাবা আর মা যাবে তোমাদের বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।"

খুশিতে প্রায় দশ মিনিট আমি কোনো কথা বলতে পারিনি। এরপর খুশিতে চিৎকার করে বললাম,"সত্যি বলছো তুমি?"

"হুম সত্যি।কিন্তু একটা সমস্যা আছে।"

"কি সমস্যা রোহান এখানে আবার?"

"আমি তো এখনো কিছু করিনা। তোমার বাসা থেকে কোনো সমস্যা হবে না তো?"

"না রোহান। আমি তাদের কোনো কথা শুনিনা। আমি যা বলি তারা সেইটা শুনতে বাধ্য। তুমি আর ভেবো না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার বাবা মা কে পাঠাও আমাদের বাড়ি।"

রোহান আমাকে আশ্বস্ত করলো। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম একটা সুন্দর সময়ের।


এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। আমি আশায় দিন গুনছি। কবে আসবে রোহান ওর পরিবার নিয়ে। হঠাৎ একদিন সেই স্বপ্নের দিন এলো। আমি নিজের ঘরে বসে গল্পের বই পড়ছিলাম। কাজের মেয়েটা এসে জানালো ড্রয়িংরুমে মেহমান এসেছে।তারা মা আর ওই লোকটার সাথে কথা বলছে। আমি নিশ্চিত হলাম রোহানই এসেছে ওর পরিবার নিয়ে। প্রজাপতির মতো উড়তে থাকলাম আমি। মাথায় ওড়না দিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসলাম আমি। যদি বাড়ি থেকে ঝামেলা করে ওর সাথে বিয়েতে আমি আজকেই এক কাপড়ে ঘর ছাড়বো ভেবে রাখলাম।

ড্রয়িংরুমের সামনে আসতেই দেখলাম সবার মুখ থমথমে। রোহান আর ওর বাবা মায়ের মুখ বেশ রাগী রাগী। মা আর ওই লোকটা অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুই বুঝতে পারলাম না। কি হচ্ছে এখানে?

"আপনার মেয়ে একটা প্রতারক। আমার সরলসোজা ছেলেটাকে জালে ফেলেছে।"

আঁৎকে উঠলাম আমি। কি বলছে রোহানের বাবা এসব? আমি রোহানকে জালে ফাঁসিয়েছি?

মা বললো,"দেখুন আপনারা কি বলছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কি দোষ করেছে আমার মেয়ে?"

আমি পা টিপে টিপে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলাম। আমাকে দেখেই রোহান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। চিৎকার করে বললো,"রিতু, এভাবে ঠকালে তুমি আমাকে?"

হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমি কখন ওকে ঠকালাম? আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মা এসে আমাকে বললো,"তুই এই ছেলেকে চিনিস?"

আমি মাথা নিচু করে হ্যা সূচক।মাথা নাড়লাম। 

"কতোদিন যাবৎ চিনিস?"

আমি আস্তে করে বললাম,"তিন বছরের বেশি।"

এবার রোহান আবার চিৎকার করে উঠলো।

"এই তিন বছরে একবারও তুমি বলোনি রিতু যে উনি তোমার নিজের বাবা নয়, সৎ বাবা।"

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম বিয়ের আগেই ওকে সব জানাবো ওকে। কিন্তু না জানিয়েই বা কি এমন অপরাধ করেছি যার জন্য ও এভাবে কথা বলছে? মা আর ওই লোকটার মুখ কালো হয়ে গেলো।

রোহান বলতে থাকলো,"দামী গাড়ি, জামাকাপড় দিয়ে তো কম ফুটানি দাওনি। আমি তো ভেবেছিলাম সব বাবার টাকায়। এখন তো শুনি সৎ বাবা।"

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,"তাতে কি হয়েছে রোহান? তুমি তো আমাকে ভালোবেসেছো। বিয়ে তো আমাকে করবে। আমার বাবা থাকুক বা না থাকুক তা দিয়ে কি আসে যায়?"

"একদম চুপ বেঈমান মেয়ে। মিথ্যাবাদী নাটকবাজ কোথাকার।"

আমি থরথর করে কাঁপতে থাকলাম। কি বলছে এসব রোহান?

হঠাৎ ওই লোকটা বললো,"অনেক হয়েছে মিস্টার রোহান। এতোক্ষণ তোমাকে আমি সহ্য করছিলাম যার কারণ আমার মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকে এমন নোংরা কথা বলার শাস্তি কি হতে পারে তুমি ভাবতেও পারবে না।"

আমি অবাক হয়ে তাকালাম উনার দিকে। কি সুন্দর করে বললেন,"আমার মেয়ে"। কেনো জানি খুব কান্না পেয়ে গেলো আমার।

রোহান টিটকারি সূচক একটা হাসি দিয়ে বললো,"আপনার মেয়ে? আপনার মেয়ে তো তিথি। রিতু আর মিতু আপনার মেয়ে না। ওরা আপনার ওয়াইফের আগের ঘরের মেয়ে। সব খবর নিয়েই এসেছি আমরা আজকে।"

আমি যেনো রোহানকে চিনতেই পারছি না। এ কি সেই রোহান? তবে কি ও এতোদিন আমার টাকার লোভেই আমার সাথে এই অভিনয় করেছে? আমার পুরো পৃথিবী যেনো উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে।

"হ্যা ও আমার মেয়ে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিথি আর রিতু মিতুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমার অবর্তমানে আমার সবকিছুই আমার তিন মেয়ের হবে সমানভাবে। আমার ঔরশজাত সন্তান না হলেও তিথি আর ওদের দুইজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই আমার কাছে। আমার যা কিছু আছে সব ওদের।"

হাত-পা কাঁপছে আমার থরথর করে। মনে হচ্ছে যে কোনো সময়  মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। কি ভুল করে ফেলেছি আমি? এ কি ভুল করে ফেললাম আমি?

সব সম্পত্তির মধ্যে আমার সমানভাগ হবে শুনে রোহানের মুখ কিছুটা কোমল হয়ে ওঠে। ওর বাবা মাও মুখে তেলতেলে একটা হাসি ফুটিয়ে দেয়। 

রোহান জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে। সেই হাসিটা অত্যন্ত বিশ্রী আর কদাকার লাগে আমার কাছে।

"হাহাহা, আসলে রিতু আমি তো মজা করছিলাম তোমাদের সাথে। দেখলাম তোমাকে চমকে দিলে কেমন লাগে তোমার। আমরা তো বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই এসেছি আজকে।"

আমি একটু হাসলাম। আস্তে করে ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,"বিয়ে করবে আমাকে?"

ও হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকালো। আমি একটু পিছনে তাকালাম। মা আর উনি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এরপর আচমকা ওর দুইগালে সপাটে দুইটা চড় বসিয়ে দিলাম আমি। একদলা থুথু মেঝেতে ফেলে বললাম,"তোর মতো লোভীকে বিয়ে করবো আমি? এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। কোনোদিন যেনো তোর এই নোংরা মুখ আমার দেখতে না হয়।"

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সবাই। উনি ছুটে এসে আমাকে বললেন"এ কি করলে রিতু মা? তুমি তো রোহানকে ভালোবাসো। রোহান যা চায় আমি দিবো। আমি শুধু তোমাদের সুখী দেখতে চাই।"

আমি কিছু বলতে যাবো, তার আগেই দেখি রোহান রাগে কাঁপতে কাঁপতে তেড়ে আসছে আমাকে মারতে। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ মেলে তাকাই আমি। দেখলাম উনি রোহানের হাত শক্ত করে চেপে আছেন। চোখ ভয়ংকর রকম লাল হয়ে আছে উনার। চাপা রোষের সাথে বললেন,"এতোক্ষণ ভদ্রতা দেখিয়েছি আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু যে হাত আমার মেয়ের উপর এভাবে আসবে সে হাত কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে আমার দুইবার ভাবতে হবে না। এক সময়ের কলেজের নামকরা গুণ্ডা ছিলাম আমি। প্রফেশন পাল্টেছি, স্বভাব নয়। তোমার মতো দুই/চারটা রোহানকে একহাতেই পিষে ফেলতে পারি আমি এখনো।"

রোহান আর ওর বাবা মায়ের মুখ কালো হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো ওরা। অপরাধবোধে ভিতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে আমার। একছুটে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে আসলাম আমি।

বেশ কিছুদিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখলাম আমি। খাওয়া দাওয়া ছেড়েই দিলাম একরকম। জীবনে করা ভুলগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে আমার। নিজেকে শেষ করে দিতে মন চায়। মামীদেত কথামতো কতো জঘন্য একটা কাজ আমি করেছিলাম। তখন না বুঝলেও এখন আমি বুঝি। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে ততদিনে। মাঝে মাঝে মনে হয় মৃত্যুই ভালো আমার জন্য। যে ভুল আমি করেছি তার কোনো ক্ষমা হয়না। পরক্ষণেই ভাবি, নিজেকে শেষ করে দেওয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। যে ভুল আমি করেছি আমার নিজেকেই সেই ভুলের মাশুল দিতে হবে। যার কাছে আমি অন্যায় করেছি সে যে শাস্তি আমাকে দিবে তা মাথা পেতে নিবো আমি।

অনেকদিন পর ঘর ছেড়ে বের হয়েছি আমি। এতোদিনের এতো ভুলের মাফ আমি সহজে পাবো না জানি। কিন্তু এটাই আমার প্রাপ্য। আমি আস্তে আস্তে পা টিপে ছাদে চলে এলাম। কারণ আমি জানি এই সময়টা উনি ছাদেই থাকেন। সন্ধ্যা মিলিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। অন্ধকারে দূর থেকে উনার সিগারেটের আগুন জ্বলজ্বল করছে। আমি আস্তে আস্তে উনার পাশে যেয়ে দাঁড়াই। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেন উনি। এইরকমই একটা দিনে উনার নামে খুব বাজে একটা মিথ্যায় দোষারোপ করেছিলাম আমি। উনি অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি উনার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ফেলে দিলাম। এতোটা অবাক মনে হয় কোনোদিন উনি হননি উনার জীবনে।

আমি আস্তে করে বললাম,"এসব আর খাবেন না। এতো সিগারেট খেলে অসুখ হয়।"

উনি হাসলেন, কি সুন্দর হাসি! বাবার হাসি কেমন আমি জানিনা। হয়তো এমনই হয় বাবাদের হাসি।

আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,"অসুখ হলে কি হবে? মরে যাবো, এইতো।"

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। উনার পা জড়িয়ে ধরলাম। চিৎকার করে কাঁদছি আমি।

"আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি ভুল করেছি। ক্ষমা করে দিন আমাকে। আপনি আমাকে যে শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নিবো। আপনি যদি আমাকে বলেন এই মুহুর্তে ছাদ থেকে ঝাপ দিতে আমি কোনোদিকে না তাকিয়ে তাই করবো। আমাকে আপনি এই অপরাধবোধের যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করুন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।"

আমার কান্না শুনে মা, মিতু আর তিথিও এসে হাজির হয়েছে। ওরা অবাক হয়ে আমাকে দেখছে।

উনি দেখলাম কোনোরকমে চোখ মুছলেন। আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,"দেখো তো আমার পাগলী মেয়েটা কি করছে।"

মা অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছলেন। 

"পা ছাড়ো রিতু মা। উঠে আসো।"

"না আমি পা ছাড়বো না। আগে আপনি আমাকে শাস্তি দিবেন। তারপর আমি আপনার পা ছাড়বো।"

"বেশ তো শাস্তি দিবো। আগে উঠে আসো তো।"

আমি উঠে দাঁড়ালাম। ফোঁপাতে ফোপাঁতে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

"সুরভি, কি শাস্তি দেওয়া যায় মেয়েকে বলো তো।"

মা চোখে মুছে হেসে বললো,"সে তোমার মেয়ে কি শাস্তি দেওয়া যায় তুমিই বুঝো।"

"বেশ! তবে তাই হোক।"

এই বলে উনি আমার দিকে তাকালেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,"তোমার একটাই শাস্তি। মিতু আর তিথি যেমন আমাকে বাবা বলে ডাকে, তুমিও আমাকে আজ থেকে বাবা বলে ডাকবে। এটাই তোমার শাস্তি। রাজি তো?"

আমি চুপ করে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে। এরপর ঝাপিয়ে পড়লাম উনার প্রশস্ত বুকের ওপর। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,"বাবা বাবা বাবা।"

যেনো কতোদিন খরার পর বৃষ্টি নামলো। আমি একনাগাড়ে বলতে থাকলাম,বাবা বাবা বাবা। 

সবার চোখে পানি। আমি ছুটে যেয়ে মা কে বললাম আমার করা সেই জঘন্য অপরাধের কথা। মা আমার মাথায় হাত রেখে বললো,"ওই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই আমি সত্যিটা জানতে পেরেছিলাম। তোমার মামীরা যখন এই বুদ্ধি তোমাকে দিয়েছিলো আমাদের বাসার গৃহকর্মী দরজার আড়াল থেকে সব শুনেছিলো। সে পরে সব বলে আমাকে। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম তোমার উপর। তোমাকে মারতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার বাবা আমাকে বলেছিলেন, তোমার গায়ে যেনো একটা নখের আঁচড়ও না পড়ে। উনি জানতেন, একদিন ঠিক তোমার ভুল তুমি বুঝতে পারবে।নিজেই ক্ষমা চাইবে। সেইদিন সত্যি এসেছে আজ।"

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম, মাথা উঁচু করার মতো অবস্থা আর নেই আমার। বাবা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমি আবার উনার বুকের উপর মাথা রেখে কাঁদতে থাকলাম। ততক্ষণে মিতু আর তিথিও বাবার দুইপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মিতু বললো,"বাহ রে, সব ভালোবাসা বুঝি বাবা তার বড় মেয়েকেই দিবে? আমরা বুঝি ভেসে এসেছি?"

বাবা মুচকি হেসে ওদেরও বুকে টেনে নিলেন। আমরা তিনবোন বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলাম। মা দূর থেকে আমাদের দেখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন।

(সমাপ্ত)

Post a Comment

0 Comments